জাহাঙ্গীর শাহের কৃষি জাদুঘর

জাহাঙ্গীর শাহের কৃষি জাদুঘর

অবাক হয়ে দেখলাম। অসাধারণ। একজন সাধারণ মানুষের অসাধারণ কীর্তি। চোখে না দেখলে বোঝা মুশকিল। কী সুচিন্তিত এই পরিকল্পনা! কী নেই এখানে? প্রবল ইচ্ছাশক্তিই পারে অসম্ভবকে এভাবে সম্ভব করতে। নতুন করে চিন্তা করতে, নতুন কিছু তৈরি করতে।’—পরিদর্শন বইয়ে কথাগুলো লিখেছেন বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী শাম্মা তাসনীম চৌধুরী। সত্যিই কী নেই এখানে? মাথার ওপরে টাঙানো সারা দেশের বিভিন্ন মডেলের মাথালের সারি। আর কৃষিকাজের নানা উপকরণ—দড়ি পাকানোর ঢ্যারা, ঢেঁকি, আমপাড়ার জালি, লাঙ্গল-জোয়াল, গরুর গাড়ির ছই, সেচের জোত, মাছ ধরার চাঁই থেকে শুরু করে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের বিভিন্ন ঢংয়ের কৃষি উপকরণে ঠাসা মাটির ঘর। আর দেয়ালজুড়ে বিশাল কৃষি পঞ্জিকা। তার ভেতরে কৃষকের স্বাস্থ্য শিক্ষা ও চাষবাসের জন্য থরে থরে সাজানো দুর্লভ সব বই। জাহাঙ্গীর আলম শাহের পৈতৃক মাটির বাড়িটি আজ কৃষি জাদুঘর।
নওগাঁ জেলা সদর থেকে ৪০ কিলোমিটার দক্ষিণে এবং মান্দা উপজেলা সদর থেকে ১০ কিলোমিটার দক্ষিণে নিভৃত গ্রাম কালিগ্রামে কৃষকদের জাগিয়ে তোলার জন্য রাজশাহী কলেজিয়েট স্কুলের সহকারী শিক্ষক জাহাঙ্গীর আলম শাহ প্রায় ২০ বছর ধরে একটি কৃষিতথ্য পাঠাগার প্রতিষ্ঠার জন্য কাজ করেছেন। ছয় বছর আগে পাঠাগারটির আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু হয়।

জাহাঙ্গীর আলম শাহজাদুঘর যা করেছে
প্রতিদিন সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত খোলা থাকে এই জাদুঘর। এখানে কৃষিবিষয়ক বই-পুস্তক ও ম্যাগাজিন ছাড়াও বাস্তবজীবনে কৃষকদের প্রয়োজন, এমন সব বিষয়ের অনেক বই রয়েছে। আছে প্রশাসন, চিকিৎসা ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থার প্রয়োজনীয় ফোন নম্বর। এ ছাড়া প্রজেক্টরের মাধ্যমে কৃষকদের উপকারী পোকা চেনানো হয়। কৃষিবিষয়ক নানা তথ্য উপস্থাপন করা হয়। এই পাঠাগারের পক্ষ থেকে সন্ধ্যাবেলায় নিরক্ষর কৃষকদের সাক্ষরতা অভিযান চালানো হয়। সকালে শিশুদের পাঠাভ্যাসের ব্যবস্থা রয়েছে।
এখানে কুল চাষে করণীয়, বীজ উৎপাদন কৌশল, ফসলের মাঠ নিয়ে চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতা, ওল বীজ বিতরণ ও প্রশিক্ষণ, কলেজ পর্যায়ে বই বিতরণ, মাদকমুক্ত সমাজ গঠনে কৃষকদের ভূমিকা ও পরিবেশ, মৎস্য চাষে করণীয়, ভেজাল সার চেনার উপায় নিয়ে কর্মশালা করা হয়৷ সেই সঙ্গে জাতীয় কৃষি দিবসে কৃষকদের উৎসাহিত করার জন্য ভালো কৃষক, ভালো হালচাষি, ভালো শ্রমিক, ভালো বীজতলা প্রস্ত্ততকারক, ভালোভাবে ওষুধ ছিটানোসহ মোট ১৩টি ক্যাটাগরিতে পুরস্কার বিতরণ করা হয়।
জাদুঘরে এক দিন
চারদিকে গাছগাছালিতে ঘেরা বিশাল এক মাটির বাড়ি। সুন্দর প্রচ্ছদের বই খোলার আগেই যেমন মোড়কটা উল্টেপাল্টে দেখতে ইচ্ছে করে, তেমনি ভেতরে ঢোকার আগেই বাড়িটার আঙিনা ঘুরে দেখার লোভ সংবরণ করা গেল না। এর আঙিনায় রয়েছে ৪৪ প্রজাতির ফলের গাছ, ১২০ প্রকারের ঔষধি গাছ। বাড়ির আঙিনার সঙ্গেই এক একর আয়তনের একটি পুকুর। এতে চলছে মাছের চাষ। কৃষকদের সবকিছু হাতে-কলমে করে দেখানোর একটি আয়োজন করে রাখা হয়েছে।
ভেতরে ঢুকতেই চোখে পড়বে চালার সঙ্গে ঝোলানো গরুর গাড়ি চাকা, ছই, জমিতে সেচ দেওয়ার জোত ইত্যাদি। সামনের খোলা বারান্দায় মাথার ওপরে ঝোলানো রয়েছে সারা দেশ থেকে জোগাড় করা বিভিন্ন ঢংয়ের মাথালের সারি। ঝোলানো রয়েছে দড়ি পাকানোর ঢ্যারা। এটি চাঁপাইনবাবগঞ্জ এলাকার। রাজশাহীর বাঘা এলাকায় ব্যবহৃত আম পাড়ার জালি ও ঠুসি। রয়েছে কৃষকের খেতের ইঁদুর মারার জন্য নানা রকমের ফাঁদ, গরুর গলায় বেঁধে দেওয়া ঘুকরা, মুখে দেওয়া টুনা, কাগজের তৈরি জাঁতার মডেল, দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের মাছ ধরার ছোট-বড় নানা রকমের চাঁই। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের হরেক রকম নিড়ানি। কাস্তে, হাতুড়ি, গাঁইতি, গরুর গাড়ি নামিয়ে রাখার শিকপাই থেকে শুরু বিভিন্ন জিনিস—দেখতে দেখতে সারা দেশের কৃষি ও কৃষকের কথা মনে পড়ে যাবে। এছাড়াও দেয়ালের একাংশ জুড়ে রয়েছে জাহাঙ্গীর শাহ উদ্ভাবিত বারো বাই ছয় ফুটের একটি কৃষি পঞ্জিকা।
পাঠাগারের ভেতরে সাজানো রয়েছে সারি সারি বই ও ম্যাগাজিন। এর মধ্যে রয়েছে মৎস্য চাষ, পশুপালন, ভেষজ এবং কৃষির পাশাপাশি ভরমণ, ছোটদের গল্প, ধাঁধা ও চিত্রাঙ্কনের বই, নবম থেকে দ্বাদশ শ্রেণী পর্যন্ত স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীদের জন্য পাঠ্যবই। পাঠাগারের ভেতরে বসে পড়ার জন্য রয়েছে চেয়ার, চৌকি ও মোড়া। যাঁরা পড়তে জানেন না, তাঁরা পাশে বসে আরেকজনের পাঠ শোনেন। জাহাঙ্গীর শাহ বলেন, ‘ছোটবেলা থেকেই আমার কৃষির প্রতি ঝোঁক ছিল। কৃষিবিষয়ক বই-পুস্তক সংগ্রহ করে পড়াশোনা করতাম। এই বিষয়ে এতোগুলো বই একসঙ্গে সাধারণত পাওয়া যায় না। এগুলো কৃষকদের দোরগোড়ায় পৌঁছে দিতে পারলে আমাদের কৃষিখাত এগিয়ে যাবে।’
এলাকার একজন সফল মৎস্যচাষি সারফিন শাহ বলেন, ‘এই পাঠাগার থেকে মাছের চাষ ও কৃষি বিষয়ে আমরা প্রয়োজনীয় সব পরামর্শ পাই। পোনা মাছ ছাড়ার পর থেকে মাছ বড় হওয়া পর্যন্ত আমরা বিভিন্ন পর্যায়ের পরামর্শ পেয়ে থাকি।’

অতিথিদের সঙ্গে জাহাঙ্গীর শাহযাঁরা এসেছেন
আমেরিকার বেক্স স্টার করপোরেশনের পরিচালক ও কিডনি রোগ বিশেষজ্ঞ স্টিভেন গেস্ট ২০০৯ সালে এই জাদুঘর পরিদর্শন করেছেন। ফিরে গিয়ে তিনি জাহাঙ্গীর শাহের কাছে ই-মেইল পাঠিয়ে এর পাঠাগারের জন্য বই নিয়ে আসার ইচ্ছা ব্যক্ত করেছেন। একই বছর জাদুঘর ঘুরে দেখেছেন জাপানি ডাক্তার কাতাসু হিরো ইয়ামসিতা ও তাঁর স্ত্রী সেইকো ইয়ামসিতা, সঙ্গে ছিলেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগের প্রধান ড. মল্লিকা ব্যানার্জি৷ অস্ট্রেলিয়ার কুইন্সল্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের আগাছা বিজ্ঞানী স্টেভ অ্যাডকিনস এখানে এসে বিষাক্ত আগাছা পার্থেনিয়াম বিষয়ে কৃষকদের নিয়ে একটি সেমিনার করেন। এছাড়াও জাপান, ভারত, কানাডাসহ বিভিন্ন দেশ থেকে অতিথিরা এসে এই কাজকে একটি চমৎকার উদ্যোগ বলে উল্লেখ করে গে