ফলদ বৃক্ষরোপণ এবং আমাদের করনীয়

ফলদ বৃক্ষরোপণ এবং আমাদের করনীয়

আমাদের আবহাওয়া ও জলবায়ু ফল আবাদের জন্য খুবই উপযোগী। বর্তমানে দেশে প্রায় ১৩০ রকম ফলের সন্ধান পাওয়া গেছে। এর মধ্যে ৭০ রকম প্রচলিত ও অপ্রচলিত ফলের আবাদ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে হচ্ছে। ফল একটি অর্থকরী ফসল। ফল গাছ কাঠ দেয়, ছায়া দেয় এবং পরিবেশের ভারসাম্য বজা রাখে।  ফল ভেষজ বা ঔষধিগুণে সমৃদ্ধ। নিয়মিত ফল খেলে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি পায় এবং সুস্থ সবল জীবন লাভ করা যায়। 

বর্তমানে একজন পূর্ণ বয়স্ক ব্যক্তির দৈনিক ফলের ১১৫-১২০ গ্রাম চাহিদার বিপরীতে প্রাপ্যতা হলো মাত্র ৩৫-৪০ গ্রাম। বাংলাদেশে সারাবছর ব্যাপী ফলদ বৃক্ষ রোপণ করা যায়, তবুও জুন থেকে আগষ্ট মাস হচ্ছে বৃক্ষ রোপণের উপর্যুক্ত সময়। 

চারা রোপণের আগে এবং পরে কয়েকটি ধাপ অনুসরণ করতে হবে। যেমন- ⏬

1⃣ স্থান নির্বাচন এবং নকশা প্রস্তুত করা

2⃣ গর্ত তৈরি ও প্রস্তুত করা

3⃣ সারের প্রাথমিক প্রয়োগ 

4⃣ সুস্থ চারা এবং জাত নির্বাচন করা

5⃣ চার রোপণ এবং প্রাথমিক আন্তঃপরিচর্যা 


স্থান নির্বাচন এবং নকশা প্রস্তুত করা


অধিকাংশ ফলগাছ জলাবদ্ধতা সহ্য করতে পারে না। ফলে বন্যা বা বৃষ্টির পানি দাঁড়ায় না এমন জমি ফল বাগান স্থাপনের জন্য নির্বাচন করতে হবে। রৌদ্রময় এবং সেচের সুবিধা আছে এমন স্থান নির্বাচন করতে হবে। উর্বর দো-আঁশ মাটি ফল চাষের জন্য উপযোগী।


ফলদ বৃক্ষ বহুবর্ষজীবী এবং বৃহদাকার হয় সেজন্য একটা নকশা করা প্রয়োজন। নকশা অনুযায়ী চারা রোপণে বিশেষভাবে যত্নবান হতে হবে। অনেক ধরনের নকশা করে বৃক্ষরোপণ করা যায়। সাধারণত সমভূমিতে বর্গাকার, আয়তকার, তারকাকৃতি, ত্রিকোণী অথবা ষড়ভূজী পদ্ধতি এবং পাহাড়ি জমিতে কন্টুর পদ্ধতি অনুসরণ করা হয়। (আপনার নিকটস্থ উপজেলা কৃষি অফিসারের কার্যালয়ে যোগাযোগ করে উপর্যুক্ত নকশা বিনামূল্যে করিয়ে নিতে পারেন)


বিভিন্ন উন্নত ফলের রোপণ দূরত্ব দেওয়া হলো-

🔰 এখানে ১ মিটার সমান ৩ ফুট। 

আম ➖ ১০ মি.❌ ১০ মি.  

লিচু  ➖ ৮ মি.❌ ৮ মি. 

কুল  ➖ ৫ মি.❌ ৫ মি.

পেয়ারা➖ ৫ মি.❌ ৫ মি.

নারিকেল ➖ ৬ মি. ❌৬ মি.

কমলা➖ ৩ মি. ❌ ৩ মি.

লেবু➖   ৩ মি. ❌ ৩ মি.

বাতাবি লেবু➖  ৬ মি. ❌ ৬ মি.

মাল্টা➖ ৪ মি. ❌৪ মি.

আমড়া➖ ৪ মি.❌ ৪ মি.

কাঁঠাল➖ ১০ মি. ❌ ১০ মি.

সফেদা➖ ৭ মি.❌ ৭ মি.

জামরুল➖ ৫ মি.❌ ৫ মি.

সফেদা➖   ৭ মি.❌ ৭ মি.

জলপাই➖  ৮ মি.❌ ৮ মি.

লটকন➖   ৭ মি.❌ ৭ মি.

কলা➖   ২ মিঃ❌ ২ মিঃ

(তথ্যসূত্রঃ কৃষি তথ্য সার্ভিস)

গর্ত তৈরি ও গর্ত প্রস্তুত করা

চারা রোপণের অন্তত ১৫  দিন পূর্বে গর্ত/ মাদা তৈরি করতে হবে। বড় বৃক্ষের জন্য ১ মি.x ১ মি.x ১ মি., মাঝারি বৃক্ষের জন্য ৭৫সেমি. × ৭৫ সেমি. × ৭৫ সেমি. এবং ছোট বৃক্ষের জন্য ৬০ সেমি.x ৬০ সেমি.x ৬০ সেমি. আকারের গর্ত তৈরি করতে হবে। চারা রোপণের ১২-১৫ দিন পূর্বে গর্তের মাটির সঙ্গে অনুমোদিত হারে জৈব ও অজৈব সার মিশিয়ে গর্ত ভরাট করতে হবে। মাটিতে রসের ঘাটতি থাকলে পানি সেচ দিতে হবে।

সারের প্রাথমিক প্রয়োগ 

একটা গর্ত/মাদা তৈরি করে চারা রোপনের ১৫ দিন আগে নিম্নের সার গুলো দিয়ে গর্ত প্রস্তুত করা যেতে পারে।বিভিন্ন ফলের ক্ষেত্রে উল্লিখিত মাত্রা কম বেশি হতে পারে, সেজন্য যখন ফলের বাগানের নকশা করা হবে তখন সারের মাত্রা জেনে নিবেন। প্রাথমিক ধারণা পাওয়ার জন্য নিম্নের তথ্য দেওয়া হলো-

⏩জৈব সার ১৮-২২  কেজি

⏩ইউরিয়া ২০০ গ্রাম

⏩ টিএসপি৪৫০-৫৫০ গ্রাম

⏩এমপি ২০০-৩০০ গ্রাম

⏩জিপসাম২০০-৩০০ গ্রাম

⏩জিংক সালফেট ৪০-৬০  গ্রাম

⏩বোরন- ১০ গ্রাম 

(তথ্যসূত্রঃ কৃষি বাতায়ন)

সুস্থ চারা এবং জাত নির্বাচন 

আমাদের দেশে উৎপাদিত ফলের ৬১ ভাগ পাওয়া যায় মে থেকে আগস্ট মাসে এবং বাকি আট মাস উৎপাদিত হয় অবশিষ্ট ফলের ৩৯ ভাগ। সেপ্টেম্বর থেকে এপ্রিল এ আট মাসে মাথাপিছু ফলের প্রাপ্যতা থাকে আরও কম।

সেজন্য আমাদের সারাবছর ব্যাপী ফল হয় কিংবা অসময়ে ফল হয় এমন জাত নির্বাচন করা উচিত। এতে পুষ্টি চাহিদার পাশাপাশি অর্থনৈতিক ভাবে লাভবান হওয়া যাবে।

এছাড়া, আপনার চাহিদা অনুযায়ী সঠিক ফলের জাত নির্বাচন করতে এবং চারা উৎস জানতে উপজেলা কৃষি অফিসারের কার্যালয়ের সহযোগিতা গ্রহণ করুন। সরকারি হর্টিকালচার সেন্টারে সুলভ মূল্যে সুস্থ সবল চারা পাওয়া যায়।

সারাবছর ব্যাপী ফল পাওয়া যায় এমন কিছু জাতের নাম হলোঃ

১। বারি কাঠাল ২ এবং ৩

২। বারি আম ১১

৩। বারি কলা ১,২,৩,৪ এবং ৫

৪। শাহী পেপে

৫। কাজী পেয়ারা

৬। বারি পেয়ার ২

৭। বারি লেবু-২,৪,৫

৮। কাগজি লেবু-১

৯। বারি জারা লেবু- ১

১০। বারি আমরা ১

১১। বারি আমলকি ১

১২। বারি কামরাঙা ১

( তথ্যসূত্রঃ কৃষি ডায়েরি ২০২০)চা

চারা রোপণ এবং প্রাথমিক আন্তঃপরিচর্যা 

চারা রোপণে সময় খুব সাবধানে চারার গোড়ার মাটির বলটি স্থাপন করতে হবে যেনো ভেঙে না যায়। চারা এমনভাবে লাগাতে হবে যাতে এর গোড়া একদম সোজা থাকে এবং মাটির বলটি গর্তের উপরের পৃষ্ঠ থেকে সামান্য নিচে থাকে এবং চারাটি যাতে হেলে না যায় এবং এর গোড়া যাতে বাতাসে নড়াচড়া করতে না পারে সেজন্য চারা লাগানোর পরপরই খুঁটি দিতে হবে। খুঁটিটি সোজা করে পুঁতে এর সঙ্গে শক্ত করে পাটের সুতলি বেঁধে চারাটি এমনভাবে বাঁধতে হবে যাতে চারা এবং খুঁটির মাঝে সামান্য দূরত্ব থাকে। 

গরু ছাগলের উপদ্রব হতে রক্ষায় বাগানে অথবা প্রত্যেক গাছে বেড়া দেয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। লাগানোর পরপরই প্রতিটি চারায় পানি সেচ দিতে হবে। চারা রোপণের পর পরবর্তী এক মাস ২-৩ দিন পরপর সেচ দিতে হবে।   

পরবর্তীতে কিছু পরিচর্যা নিয়মিত করতে হবে। যেমন-

🌹গাছের মুকুল/ফল ভাঙন 

ফলদ গাছ রোপণের পরবর্তী বছর থেকেই মুকুল আসতে শুরু করে এবং অনেক ক্ষেত্রে সীমিত হারে ফলও হয়। কিন্তু গাছের বয়স ২/৩ বছর না হওয়া পর্যন্ত মুকুল ভেঙে দিতে হবে।

🍀 ডাল ছাঁটাইকরণ 

গাছকে সুন্দর কাঠামো এবং পরিপূর্ণভাবে বৃদ্ধির জন্য গোড়ার দিকে বৃক্ষভেদে ০.৫ -১.৫ মিটার কাণ্ড রেখে নিচের সব ডাল ছাঁটাই করতে হবে। ফল আহরণ এবং বর্ষার শেষে মরা, রোগাক্রান্ত ও দুর্বল ডালপালা কেটে দিতে হবে। এছাড়া গাছ বেশি ঝোপালো হলে অতিরিক্ত ডালপালা ছাঁটাই করে আলো বাতাস চলাচলের ব্যবস্থা করতে হবে।

🌵আগাছা দমন 

ফল বাগান সব সময় আগাছামুক্ত রাখতে হবে। 

🌻 সার প্রয়োগ 

ফলের গাছে সাধারণত বছরে দুইবার সার প্রয়োগ করতে হয়। বর্ষার শুরুতে হালকা বৃষ্টি হওয়ার পর মাটিতে রস এলে ১ম কিস্তি এবং বর্ষার শেষে আশ্বিন-কার্তিক মাসে বৃষ্টির পরিমাণ কমে এলে ২য় কিস্তির সার প্রয়োগ করতে হয়। দুপুর বেলায় যে পর্যন্ত ছায়া পড়ে তার থেকে সামান্য ভেতরে গোলাকার রিং/ নালা তৈরি করে সার প্রয়োগ করা যেতে পারে। 

🌳পানি সেচ ও নিষ্কাশন 

শীত ও গ্রীষ্ম মৌসুমে বিশেষ করে ফল ধারনের পর এবং ফলের বাড়ন্ত অবস্থায় ২-৩টি সেচ প্রয়োগ করা আবশ্যক। প্লাবন সেচ না দিয়ে রিং বা বেসিন পদ্ধতি অবলম্বন করা। বৃষ্টিতে অতিরিক্ত পানি না জমাতে দ্রুত পানি নিষ্কাশনের সুব্যবস্থা থাকা জরুরি, সেজন্য  নিষ্কাশন নালা তৈরি করতে হবে।

🌲বালাই ব্যবস্থাপনা 

নিয়মিত বাগান পরিদর্শন এবং প্রতিটি গাছ ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করে রোগবালাই দমনের ব্যবস্থা নিলে ফল বাগান স্থাপন লাভজনক হবে।


(পরিকল্পিত ভাবে ফলের বাগান করতে অবশ্যই উপজেলা কৃষি অফিসারের কার্যালয়ের সহযোগিতা গ্রহণ করুন) 


🖋 কৃষিবিদ মোঃ জাহাঙ্গীর আলম লিটন 

      কৃষি সম্প্রসারণ অফিসার, কচুয়া, চাদপুর।